Tuesday, August 6, 2013

রথযাত্রা লোকারণ্য, মহা ধূমধাম

রাত পোহালেই রথ
আর সেই সুত্র ধরে একটা দীর্ঘ জীবনের পর বিকেলের নিভে যাওয়া আলোর পথ ধরে আমি বাড়ি ফিরছি ।
সেই চেনা শহর, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষের ভিড়, দ্রুত পথচলা, বাস, ট্রাম, ট্যাক্সির রোজকার শব্দ, আর লাল-সবুজ ট্রাফিক সিগন্যালের আলো । একটা ধুলোমাখা ক্যানভাসের মতো এই ছবিগুলোকে কাঠের চৌকোনো ফ্রেমে সাজিয়ে বাসের জানলা দিয়ে শহর দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরতে আমার বেশ লাগে ।
“ আমি দেখতে ভালবাসি “ ।
বর্ষার এই মরশুমটায় রিমঝিম রুমঝুমেরা মাঝে মাঝেই নিজেদের উপস্থিতি জানিয়ে যাচ্ছে, তাই শেষ বিকেলের এক পশলা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট সব ভিজে আছে, দু-ধারের ফুটপাথে দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসেছে । আর কখন জানি এসবের মধ্যে একটুখানি জায়গা ভাগ করে নিয়েছে লাল হলুদ সবুজ কাঠের তৈরী একতলা - দোতলা - তিনতলা রথগাড়িগুলো ও মাটির খুদে খুদে ছোট্ট তিন ভাই বোনের দল মানে আমাদের প্রানের ঠাকুর জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা । এ যেন উত্সবের শহর …

ছোটবেলায় শুনেছিলাম রথ উত্সবে নাকি জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা তাদের মাসীর বাড়ি ঘুরতে যায়, তবে একটু বড় হতে মানে এই ক্লাস সেভেন এইটে উঠে বুঝলাম  রথ উত্সব মানে বাংলায় ভাবসম্প্রসারণ । ওই যে বাংলা পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো না -

‘‘ রথযাত্রা লোকারণ্য, মহা ধূমধাম
ভক্তেরা লুটায়ে পথে, করিছে প্রণাম
পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’
মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’, হাসে অন্তর্যামী ’’

কি কঠিন ছিলো, আমি কোনদিন লিখতে পারিনি ...
যাইহোক ছোটোবেলায় আমার ঐরকম একটা তিনতলা কাঠের রথ ছিল আর সেটা বাপ্পার টিনের রেলগাড়িটার মত পাই পাই করে ছুটতো । রথের ঠিক আগের দিন দুপুর বেলা এবং পরের দিন সকালেও দাদা রঙিন কাগজ কেটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিত রথের গায়ে, তারপর হাতে তৈরী রঙিন কাগজের ফুল, মালা আর রং বেরঙের পাতাবাহারি গাছের পাতা দিয়ে আমার রথটা কি সুন্দর সেজে উঠতো । বিকেল হলেই সেই রথ নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম পাড়ার রাস্তায়, বড় পুকুর টার চারপাশে একপাক ঘুরে দাদার হাত ধরে এসে দাড়াতাম বড় রাস্তার মোড়ে । সন্ধ্যের আলোয় সেখানে নেমে আসতো রথের মেলা ।

আবার কৈশোরে রথ উত্সব বলতে বুঝলাম রাধারানীর প্রেম,
মানে সেই বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী - চির অভাগী রাধারানীর গল্প  -
যে পীড়িত মায়ের পথ্যের জন্য বনফুল দিয়ে মালা গেঁথে বৃষ্টি ভেজা রথের মেলায় বেচতে এসে রুক্মিণীকুমার রায়ের প্রেমে পড়ে - সেই গল্প ।

এখন রথের দিন ছুটি থাকলে ভাইপো টার জন্য রথ সাজিয়ে দিই, ঠিক আমার ছোটবেলার মতো করে । দুপুরে ঘুমিয়ে কাটাই, সন্ধ্যে হলে পাড়ার দোকান থেকে পিঁয়াজি, আলুর চপ আর গোটা গোটা পাপড়ভাজা কিনে এনে সবাই মিলে  হই হই করে ভাগ করে খাই । পাপড়ভাজা রোজ ঘরে হলেও বাইরের পাপড়ভাজার একটা আলাদা স্বাধ গন্ধ থাকে যেটা অসাধারণ । বিশেষত এই রথের দিন পাপড়ভাজা খাওয়া অনেকটা বিজয়ার কোলাকুলির মতো অনন্য । আসলে আমাদের মতো হুজুগে বাঙালিরাই জানে উত্সবের রূপ-রস-গন্ধ টা ঠিক কি?


রথ উত্সবের আরেকটা  বৈচিত্র হলো এই দিনেই বনেদী বাড়িগুলোতে দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটে, মা দুর্গার কাঠামো পুজো হয় । এই দিন থেকেই হয়ত বাঙালি দুরু দুরু বুকে রোজ রাতে শুতে যাবার সময় ক্যালেন্ডারে দিন গোনা শুরু করে । অফিস ফিরতি পথে কুমোরটুলি পাড়ার সেই স্যাতসেতে ভেজা এঁদো গলিটায় আমার যাতায়াত বাড়তে থাকে ।
সেই ছোট্টবেলা থেকেই ঠাকুর গড়া দেখতে আমার বড্ড ভালো লাগে । আমার মতো আশায় বাঁচে যে সব চাষা  তাদের কাছে পুজোর থেকেও পুজোর এই অপেক্ষা অনেক বেশী  আনন্দের, অনেক বেশী প্রিয় । তাই আগামীকাল রথের দড়িতে টান পড়ুক, উত্সবের সুচনা হোক । চারপাশ আনন্দে মেতে উঠুক আর আমার মন জুড়ে থাকুক একরাশ খুশীর অপেক্ষা .........

1 comment:

  1. aar she din nei tumi bhgyoban tai ekhono paro anonder opekkha korte amra to anondo ele bhoi pai kotho dukkho shoar obbhesh ta chhere gele dudin por to koshto barbe

    ReplyDelete