" বসন্তে কোকিল কেশে কেশে রক্ত তুলবে এ আবার কিসের বসন্ত? " সেই
কবে মৃত্যুর আগে কোনো এক তরুণ কবি এ কথা বলে গেলেও আজও বসন্ত তার আপন
নিয়মেই ডালিভরে রূপ-রস-গন্ধ বিলি করতে আসে এই শহরের অলিতে-গলিতে । ধুলোমাখা
ফুটপাথে লাল-হলুদ পাতারা যখন নিঃশব্দে হাওয়ায় ঝরে পড়ে, তখন আকাশের দিকে
আলো ছড়িয়ে দেয় পলাশ-শিমুলের সূর্য । গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা কোকিলের ডাক,
সকালের পাতিলেবু রঙের গুঁড়ো গুঁড়ো মিহি রোদ আর বুনো টিয়ার সবুজ পাখায় জেগে
ওঠে ঋতুরাজ । আসমানী বিকেলগুলো আসতে আসতে গোলাপী হয়ে ওঠে, যা আমার মতো
হাড়িচাঁচার মনকেও বুঝিয়ে দেয় যে অবশেষে এই দেশলাই বাক্সের শহরে হাজির - "
আনন্দ-বসন্ত-সমাগমে"
ঠিক এই সময় বিকেল শেষে একটা অদ্ভুত
হাওয়া দেয়, মা বলে এই হাওয়া গায়ে লাগাতে নেই, মায়ের কথার অন্তর্নিহিত মানে
খুজতে বসিনি কোনদিনই শুধু বুঝি মায়ের বয়সী মানুষেরা কতো কিছু জানে, তারা
জানে শুধু নিছক একটা হাওয়া মানুষকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে দিতে পারে । তবু
ছোটবেলায় মন কেমন করা সেই হাওয়ার মাঝে যখন পড়তে বসতাম তখন বিকেল শেষ হয়ে
আসতো । সামনের বইয়ের পাতায় সমুদ্রগুপ্ত কে খুলে রেখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে
থাকতাম দুরে বাবলিদের উঁচু বাড়ির চৌকোনো চিলেকোঠাটার দিকে । আলো ছুটি যাওয়া
বিকেল শেষে সেই ছাদে এসে বসতো ঘরে ফেরা কাকের দল, আর কখন যেন মানুষের
গন্ডি ছেড়ে আমার অপরিণত মন, জায়গা করে নিতো কাকেদের ভিড়ে ।
অবিস্যি
বসন্তের কাকেরা বড্ড চঞ্চল, রোজ সকালে দাঁত মাজার সময় খেয়াল করি আমার
বাড়ির ছাদ লাগোয়া রাশি রাশি মঞ্জরীতে ভরা আমগাছটায় বাসা বেঁধেছে এই
সদাচঞ্চল কাকেরা । সামনের রাজুদাদের শ্যাওলা মাখা কুয়োতলার কোনায় রাখা
ঝাঁটা থেকে ঠোঁটে করে একটা একটা করে কাঠি খুলে নিয়ে এসে জড়ো করছে সেই বাসায়
। তাছাড়া কদিন ধরেই দেখছি আমাদের চিলেকোঠার ঠাকুর ঘরে মা কালির ফটোটার
পিছনে আবার সংসার পেতেছে চেনা চড়াই দুটো, রোববারের দুপুরে ওদের বাসা বোনা
দেখি, কোত্থেকে সারা রাজ্যের শুখনো ঘাস-পাতা জড়ো করে এনেছে ফটোর পিছনটায় ।
দুজনে ঠোঁটে ঠোঁট ঘসে খুনসুটি করে, যেন " এ তেরা ঘর এ মেরা ঘর " ছবির শুটিং
চলছে । আর ওই হাসিন ঘরেই এই বসন্তে ওরা আবার উপহার দেবে ছোট্ট দুটি ছানা,
তাদের কিচিরমিচির শব্দে ভরে উঠবে এই ঘর-সংসার । তারপর একদিন বাসা ফেলে,
শুখনো খড়-কুটো ফেলে, ফটোর পিছনের অন্ধকারকে দুরে সরিয়ে উড়ে যাবে আকাশের
নীলিমায় । এ যেন কবির কথাই সত্যি করে তোলে বারবার - " রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও
গো এবার যাবার আগে "
হবে নাই বা কেন? বসন্ত যে রঙের উত্সব,
সারা বছরের ধুসর-ধুলোমাখা দিনগুলোকে রাঙিয়ে দিয়ে যাবার উত্সব, দোল উত্সব ।
কোনো রঙ আমার এই প্রাগৈতিহাসিক শরীরটাকে কোনদিন রাঙিয়ে তুলতে না পারলেও এই
বিবর্ণ দেহের আনাচে-কানাচে রঙ খেলার কিছু মিষ্টি অনুভুতি আজও জীবাশ্ম
হয়ে বেঁচে আছে । মনে আছে ছোটবেলায় আমরা যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম তার চারপাশে
অনেক ছোট ছোট ঘর ছিল আর সেই ছোট ছোট ঘরের বড় বড় দাদা-দিদিরা মিলে বাড়ির
মাঝখানের ছোট্ট চারকোনা উঠোনটায় দোলের আগেরদিন রাতে নেড়াপোড়া করত । প্রায়
এক সপ্তাহ ধরে উঠোনে জড়ো করা শুখনো নারকোলের পাতা ও ডালপালা দিয়ে
তৈরী বুড়ির ঘর যখন জ্বলে উঠতো তার পলাশ-শিমুল আগুনে-রঙ রাঙিয়ে দিতো
আমাদের রাতের আকাশ । সেই ফাগুনের অদম্য আলোয় বারান্দার এক কোনে দাড়িয়ে
থাকতাম আমি, উদ্যাম আগুনের নৃত্যে আর বড়দের হই-হুল্লোরে আমিও নেঁচে উঠতাম,
মাঝে মাঝেই দৌড়ে যেতে চাইতাম উঠোনের মাঝখানটায় । কিন্তু মা, দাদারা কেউ না
কেউ পরনের স্যান্ডো গেঞ্জিটা অথবা প্যান্টটা টেনে ঠিক আটকে দিতো সন্ধ্যের
সেই আক্ষেপ মিটে যেত একটু রাত বাড়লেই, যখন দাদা কারখানা থেকে বাড়ি ফিরত
আমার জন্য একটা পেলাস্টিকের পিচকারী আর একটা বেলুনের প্যাকেট কিনে নিয়ে ।
ওই বেলুনগুলোতে আমি রঙ-জল ভরে ছুড়তাম না, ওগুলো রাতে দাদা একটা একটা করে
ফুলিয়ে দিতো আর আমি খাটের কোনায়, জানলার পাল্লায়, দাদার সাইকেলে, অথবা
গামছা মেলার দড়িতে ঝুলিয়ে রাখতাম । পরদিন সকালে দাদা একটা বালতির জলে জামা
কাপড় কাচার নীল রঙ গুলে দিতো, আমি সেই বালতি থেকে পিচকারীতে রঙজল ভরে
দুয়োরের সামনের পেঁপে গাছটার গোড়ায় ছুড়তাম । কাকভোরে আমার রঙ খেলার সাথী
বলতে ছিল এই পেঁপে গাছটা আর আমার মা । মা নিমপাতা ঝরে পড়া উঠোন ঝাট দিতে
দিতে, বারোয়ারী কল থেকে জল ভরে আনতে আনতে, বাসন মাজতে মাজতে যখনই আমার কাছে
এসে দাড়াত আমি পিচকারী দিয়ে মায়ের সারা গা রঙ জলে ভিজিয়ে দিতাম । আজ বুঝি
মা'রা কত ভালো হয়, ওই ভেজা শরীরেও কাজ করতে করতে মা আমাকে খেলার সময়টুকু
দিতো, কখনো বিরক্ত হত না । আসলে মা'রা তো পুকুরের মতো, রঙ খেলার পর দামাল
ছেলেরা যেমন পুকুরের সবুজ ঘন জলে এসে ঝাঁপ মারে তখন তাদের সারা দেহের লাল,
হলুদ, সবুজ রঙগুলো পুকুরের জলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় । আমার মা ও
তেমনি আমার সমস্ত রঙিন স্বপ্নগুলোকে নিজের গায়ে এঁকে বহন করে চলত । একটু
বেলা বাড়লেই আসেপাশের ছোট ছোট ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে আসত রাখিদি, দীপাদি,
বন্যাদির দল, তারা বড়দের রংখেলায় মেতে উঠতো । মাঝে মাঝে দৌড়ে এসে আমার লাল
টুকটুক ফর্সা গালেও রং মাখিয়ে যেত । সেই রঙ সময়ের ইতিহাসে জীবাশ্ম হয়ে
গেলেও তার গোলাপী আভা আমি আজও অনুভব করি । স্নান সেরে মা যখন পুজোয় বসত
ঠোঙ্গা থেকে বার করে গোলাপী, হলুদ আর সাদা রঙের হাতি, ঘোড়া পুতুলের চিনির
মঠ থালায় রাখতো ঠাকুরের সামনে । তবে পুজোর আগেই মা একখানা মঠ আমার হাতে
গুঁজে দিতো আর আমিও মহা আনন্দে চুপ করে বসে থাকতাম । আমরা বামুন পরিবার তাই
দোল পূর্নিমার বিকেল শেষে দেখতাম মায়ের থেকে যারা বয়সে ছোটো তারা আসতো
মাকে আবির মাখিয়ে প্রনাম করতে । মা তাদের হাতে মঠ- ফুটকড়াই খেতে দিতো আর
প্রতিবার আমিও কিছু ভাগ পেতাম । ছোটবেলার দোল উত্সবের দিনগুলোর সেই সুন্দর
স্মৃতি আজও মনে গেঁথে আছে ।
এখন রঙের উত্সবে আমার অফিস ছুটি
থাকে, উঁচু বাড়ির ঝুল বারান্দায় দাড়িয়ে সারাদিন পাড়ার কচি-কাঁচা ছেলে মেয়ে
দের হই-হুল্লোর দেখি তবে নিজেকে আর রাঙিয়ে তোলার চাহিদা অনুভব করি না ।
থেমে থাকা ছিন্ন ভিন্ন হাসির মতো পুরোনো সেই দেয়ালের ছাপ ছাপ রঙ, চৌকোনো
উঠোন, দাদার সাইকেল, গোলাপী গাল, পিতলের থালায় রঙিন মঠ, মায়ের ভেজা শরীর
জেগে আছে আমার চারপাশে । এটাই আমার জগৎ আমার জীবন । তবে আমি মনে করি
প্রত্যেক মানুষকে জীবনে একবার রঙ খেলা উচিত, একমাত্র বসন্তের রঙই মানুষের
বিবর্ণ জীবনকে রাঙিয়ে তুলতে পারে । পৃথিবীর কাউকে কোনদিন যেন সেই সার্থপর
দৈত্যটার মতো আফসোস না করতে হয় - " How selfish I have been, now I know
why the spring would not come here " । তাই প্রত্যেক মানুষের মনের বাগানে
বসন্ত জাগ্রত হোক, বসন্তের আকাশে আকাশে চন্দনের গন্ধ ভাসুক , গাছভরা বকুল
ফুল ঝরে পড়ুক …
বত্সর শেষে লাল-হলুদ ফুল বিছানো পথে
পরিশ্রান্ত পথিক যে ছায়াপথ এঁকে যায় আগামীর সূর্য সেই পথেই নতুন আলো ঝরায়,
সেই পথেই পাখি গান গায়, আকাশী-নীল ছেলেদের সাথে গোলাপী-হলুদ মেয়েরা পথে
নামে, আবার ভালবাসা উপচে পড়ে । আর এই ভালবাসার বসন্তের জন্য, এই সত্যিকারের
রঙের জন্য মানুষের অপেক্ষা থাকে চিরকাল, কোনো এক অসম্পূর্ণ চাঁদের ভাঙ্গা
বৃত্তের মতো ...