একটা রোদে পোড়া মানুষের গপ্পো আর কেই বা শুনতে চায় বলো? কিন্তু যদি তোমরা শুনতে চাও তাহলে ওই জয় গোসাই এর মতো আমিও এক পৃথিবী বলতে পারি ! এই বিশাল মাঠে সেই কবে থেকে একা নিধিরাম সর্দার হয়ে দাড়িয়ে আছি | চারিপাশে কেও নেই, শুধু মাথার উপর আছে অনন্ত আকাশ আর সেই আদি অনন্ত সুয্যি দেবতা | সে বেটাও যেন আধুনিক সমাজে তার চরিত্তির বদলেছে | হিংস্র হয়ে উঠছে দিন কে দিন, যেন তার রক্তচক্ষু থেকে নিসৃত সূর্যালোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষিত করবে এই সমগ্র পৃথিবীকে ! কিসের যে এত রাগ কে জানে? অবিস্যি এর জন্য ঠিক কে দায়ী ইতিহাস সেটা পরে ঠিক বলে দেবে ! কিন্তু সে ইতিহাস কারা পড়বে?
গায়ের ঢিলে জামাটা ফরফর করে উড়ছে, মনে হলো দেহটাও একটু নড়ে উঠলো | অবিস্যি জামাটাও আমার নয়, ওই পাশের গ্রামের ইটভাটায় ভ্যান চালায় আব্দুল, ওর, গতবছর বাতিল করে দিয়েছে তাই আমার গায়ে উঠেছে | তবু ভালো আজ সকাল থেকেই হওয়া বইছে, নইলে এই চৈত্তির মাসের কাঠফাটা রোদে কার আর থাই দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে? কিন্তু বাপ ঠাকুরদার আমলের চাকরি তাই কাজ টার উপর কেমনি যেন একটা মায়া পড়ে গেছে | আর এই লোকগুলোও খুব ভালো, সরল সাদা প্রাণ, চাষাবুশো হলেও যেন সততার জলজ্যান্ত প্রতীক | নির্বিকার চিত্তে ওরা কাজ করে মাঠে ঘাটে, মাঝে মাঝে আমার গায়েও হাত বুলিয়ে যায় পরম স্নেহে | ঢিলে জামাটাকে টেনে হিচড়ে ঠিক করে দেয়, মুখের আঁচর গুলোকে আরো স্পষ্ট করে এঁকে দেয় | তবে আমার মুখতো সে আর কত সুদর্সন হবে? আধুনিক যুগের কোনো ছাপ এই মুখের উপর আজও পড়েনি, শতাব্দী প্রাচীন এই মুখ জলে ভিজে, রোদে পুড়ে এক্কেবারে সিজনড হয়ে গেছে |
সেই দুপুর থেকে একটা থমথমে ভাব চারিপাশে, একটা ঝড় আসবে বোধহয়, দুরে কালো মেঘের উপর মেঘ জমেছে, যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়বে এখুনি | এইতো ঝড়ের সময় ! সময় এসেছে সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার | হয়তো এই ঝড়ে আমিও উড়ে যাব খড়কুটোর মতন, তাতে ক্ষতি কিছুই নেই | নতুন কেও আসবে, দখল করে নেবে আমার জায়গা | আমি আর কতটুকুই? তুচ্ছ আমার পরিচয় | কিন্তু সময় আমায় শিখিয়েছে ঝড়ের সঙ্গে বুক চিতিয়ে মোকাবিলা করার, চেষ্টাটাই আসল, আমি করেছি | ভিত শক্ত না হলে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয় না...
মাথার উপর কালো মেঘ বৃষ্টির বার্তা এনেছে | ঝড়ের দমকা হাওয়ায় এক ফোঁটা বৃষ্টি জায়গা করে নিল আমার মুখের উপর | মুহুর্তে তপ্ত পোড়া মাটি চুষে নিল তার সমস্ত রস | শান্তির এই বারিধারা শান্ত করবে আমাকে, হয়ত তোমাকেও | আমার তপ্ত ঘর্মাক্ত দেহ শান্ত হবে, ঢিলে জামাটা ভিজে চুপসে ফিরে পাব আমার আসল রূপ | ধুয়ে যাবে মুখের সমস্ত কালির আঁচর | সকালে যে কাকটি রোজ আমার মুখের উপর বসে প্রাতরাশ সারে, সেই বন্ধু পাখিটিও ফিরে এসেছে ঝড়ের আশঙ্কায় | আমার মাথার উপর বসে, কোনো এক অতীতের বিয়েবাড়ির শেষ পাতে চেটেপুটে খাওয়া দইয়ের হাড়ির গায়ে দু-চার বার ঠোঁট ঘষে আমায় বলল বন্ধু ঝড় আসছে যে! আমি চুপ রইলাম |
আমি কাকতাড়ুয়া | কাকেদের সাথে আমার মিল থাকলেও ঝড় উঠলে ঘরে ফেরার আমার কোনো তাগিত নেই | ঘর হারানোর কোনো দুশ্চিন্তা নেই |