Monday, February 25, 2013

দুপুর


আপাতত নিরীহ দুপুরটাকে বড্ড শান্ত মনে হয়
শুধু পুকুর ঘাট থেকে একটা শব্দ অনবরত ভেসে আসচ্ছে ...
কাপড়কাচার শব্দ,
সেই সঙ্গে আরো কিছু শব্দ মিলে মিশে যাচ্ছে,
অবিরাম কাকের ডাক, মুড়িয়ালার হাঁক, সাইকেলের শব্দ !


আজ অফিসে যাইনি, ছাদে দাড়িয়ে শেষ শীতের রোদের ওমটাকে গায়ে মেখে নিচ্ছি ...
বহুদিনপর কোনোও রোদ প্রাগৈতিহাসিক এই দেহটাকে ছুঁলো ...
প্রত্যেক মানুষের জীবনে অন্তত একবার রোদ পোহানো দরকার,
দেহের প্রাচীন জীবাশ্মগুলো এতে প্রাণ ফিরে পায় ...
কখন জানি না এই রোদ ছাদের মেঝেতে আমার একটা ছায়া এঁকে গেছে,
নিজের ছায়াকে দেখে নিজেকে মহীরূহ বলে মনে হলেও,
এই মহীরূহকে তোয়াক্কা না করেই দুটো চড়াই চিলেকোঠার ঠাকুর ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে,
হয়তো নতুন করে বাসা বাঁধবে ...
নিচ থেকে মা ডাকে - " কিরে ভাত খাবি না? "
আমি সাড়া দিইনা, নীচে নেমে আসি ...
মায়ের ডাক ছাড়া,
আপাতত নিরীহ দুপুরটাকে বড্ড শান্ত মনে হয়

জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে

শীতের সেই নীলাভ বিকেলগুলো ক্রমশও ফিকে হয়ে আসছে, আর সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে একটা হলুদ গোলাপী আলো আলো রঙ যা ছড়িয়ে পড়ছে এই ধুলোময় শহরটার আনাচে কানাচে । এরকম স্বপ্ন আমি মাঝে মাঝেই দেখি । কিছুক্ষণের জন্য ভেবে নাও স্বপ্ন দেখাই আমার কাজ । এই তো কিছুদিন আগে পর্যন্ত এ শহরে শীত বুড়ো জুবুথুবু হয়ে বসে ছিল কিন্তু এখন পাতাঝরার  মরশুম শেষ হয়ে এল প্রায় । আসলে শুন্যস্থান বলে কিছুই হয়না তাই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পলাশ, শিমুল, গুলঞ্চের শাখায় শাখায় কোত্থেকে আবার নতুন পাতারা আসতে শুরু করেছে - গাছেদের নতুন হয়ে ওঠার সময় এল, রক্তবর্ণ ফুলগুলো ফুটল বলে। এই পাগলা হাওয়ার শহরটাও রঙ মাখতে জানে । নিন্দুকেরা বলে এ শহরে নাকি বসন্ত আসে না, কিন্তু আমি যে দেখি সেই রঙ " ভালবাসার এক ঋতু রঙ " । যখন একঝাক কিশোর কিশোরীরা পাতাঝরার মরশুমকে পিছনে ফেলে চুইংগম চিবোতে চিবোতে রাস্তা দিয়ে হাটে তখন সেই রঙ এঁকে দেয় শহরের চালচিত্র, তাদের ভ্রুপল্লভের ডাকে ভেসে আসে চন্দনের গন্ধ । একটা সময় ছিল যখন বসন্ত আমার মন কেউ রাঙিয়ে যেত, কিন্তু আজকাল মরচে ধরা হৃদয়ে  গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার টিপটিপানি ছাড়া কিছুই অনুভব করি না । আর এই সবকিছু পাওয়া আর সবকিছু চাওয়ার মাঝে একটা রঙিন ঋতুকাল মাখামাখি হয়ে থাকে যার জন্য আমাদের অপেক্ষা থাকে চিরকাল ।
অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ ধরে, ঠিক চিত্পুর থানার সামনে বাসটা জ্যামে আটকেছে । এইসময় আমার একদম ভালো লাগে না, বিকেল শেষে বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ছটফট করে । রোজ যেন যুদ্ধশেষে রাজপুত্তুরের রাজ্যে ফেরার আকুলতা । অগত্যা বাসের জানলা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিলাম । বিকেলের নিভু নিভু সদ্য জন্মানো নিয়নের আলোয় ভিজে যাচ্ছে শহর । দেশলাই বাক্সের মত দোকানগুলোয় পসরা সাজিয়ে বসছে দোকানদার । আর সেই সঙ্গে একটা অদ্ভুত শব্দ । ফেরিয়ালা,  সাইকেলয়ালা, অটোয়ালা, রিক্সায়ালা, ট্যাক্সিয়ালা, বাসের কন্ডাক্টরের হাঁক, পথচলতি মানুষের পায়ের শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে আরো কত চুপ থাকা শব্দরা । এমন সময় একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, দেখি এক ফুচকায়ালা তার চার চাকার সাইকেল ভ্যানটাকে আমাদের বাসের পাশ দিয়ে ঠেলে নিয়ে চলেছে । আর সেই ফুচকাগাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে হেটে চলেছে বছর চার পাঁচের একটি ছোট্ট ছেলে হয়ত তার ফুচকায়ালা বাবার হাত ধরে । গাড়ির উপর ফুচকা বাক্সের পাশে একটা মাটির টক জলের বড় হাড়ি আর তার পাশে ছোট্ট একটা ফুটফুটে মেয়ে বসে আছে । নীল ফ্রক পরা । কোলে একটা ওর থেকেও পুঁচকে সরস্বতী ঠাকুর নিয়ে বসে  টুকুস টুকুস করে তাকাচ্ছে চারপাশে । ওর এইটুকুনু মিষ্টি মুখ আর ওর সেই মিষ্টি পুঁচকে সরস্বতী ঠাকুরটা কে দেখে আমার ক্লান্ত মনটা বড্ড ভালো বড্ড সবুজ  হয়ে উঠলো । দূর থেকে ভেসে আসা ফুলের গন্ধের মতো মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা । তখন বাবা সরস্বতীর পুজোর আগের দিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ভাইঝিকে কোলে নিয়ে আর আমার হাত ধরে ঠাকুর কিনতে যেত । আমি অনেক বায়না করলেও বাবা সাদা ও আকাশী রঙের ছোট মাটির ছাঁচের ঠাকুর কিনতো । কিন্তু আমার মন চাইতো রঙিন কাপড় পরা ঠাকুর কেনার । কিন্তু  বাবা বলত ওগুলো নাকি খুব দামী । তাই আর কেনা হত না । কিন্তু তবুও একটা আসমানী আনন্দ ছায়ার মতো আমার চারপাশ দিয়ে বয়ে যেত । বাড়ি ফেরার পর মা  দুয়োরে দাড়িয়ে উলু দিত আর বাবা আমাদের ও ঠাকুর সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকত । এরপর দাদা একটা খবরের কাগজ দিয়ে ঠাকুরের মুখ টা ঢেকে দিত । কিন্তু আমি মাঝে মাঝেই কাগজ সরিয়ে লুকিয়ে ঠাকুর দেখতাম আর গায়ে হাত বোলাতাম । বড্ড আপনজন মনে হত আমার ওই শান্ত মাটির মূর্তি টিকে । ওর  কাছে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ । হয়ত কাচা মাটি আর নতুন রঙের গন্ধ মূর্তি টিকে আমার কাছের মানুষ করে তুলত । পুজোর দিন খুব সকালে মা কুয়োতলায় গায়ে কাঁচা হলুদ আর তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিত । মা যখন ফল কাটতো পুজোর থালা থেকে নারকলি কুল তুলে খেয়ে নিতাম । মা ফুল ফল দিয়ে ঠাকুর সাজাতো । বাবা  পুজোয় বসে অঞ্জলির মন্ত্র বলত  " জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে " আর আমি ভুল সব মন্ত্র বিড়বিড় করে বলে তড়িঘড়ি অঞ্জলি দিয়ে দুপুরে স্কুলে যেতাম লুচি, আলুরদম আর দরবেশ খেতে । একটু বড় হতেই স্কুলের সরস্বতী পুজোয় ঠাকুর সাজানো, বন্ধুদের সাথে মিলে সাইকেল নিয়ে হৈহুল্লোর, নানান মেয়েদের স্কুলের রাস্তায় চক্কর মারা, স্কুল গেটের সামনে এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা - যেন শাড়ি পরা মেয়ে বস্তুটাই পৃথিবীতে এই প্রথম পা রাখল । এখন বুঝি টিনেজার বয়সটাই ছিল অন্যরকম । বড্ড রঙিন ছিল সেই দিনগুলো । একটা গোলাপী বিকেল সবসময় জড়িয়ে থাকত আমায় । ঠিক সেই বিকেলটাই যেন আজ জড়িয়ে আছে এই নীল ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটির চারপাশে । স্মৃতির সময় সুখ-দুঃক্ষ কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলে । দেখলাম ফুচকায়ালার গাড়িকে পিছনে ফেলে আমাদের বাসটা এগিয়ে চলল । আমি পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলাম । শেষ বিকেলের চুইয়ে পড়া আলোয় তারা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে । সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সেই গোলাপী বিকেল, কুয়োতলা, মায়ের উলু, আসমানী রঙ আর ফিকে হয়ে আসা বন্ধুত্ব । সেইসব হাজার হাজার বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে তুলতেই বসন্ত ফিরে আসে।বসন্ত ফিরে আসে বারবার ।

" ভালোলাগে তাই ভালবাসি "


ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া ফুলের গন্ধের মতো কেন কেউ কোনদিন অমন করে তাকায়নি,
দাড়িবুড়ো কেন গানখানি শেখালো না  " সখী ভালবাসা কারে কয়? "
আমি চিরকাল লাজুক আর চুপচাপ বলেই কি?
ভাঙ্গা প্রাচিলের পাশে বেড়ে ওঠা সেই ধূলোলাগা ডুমুর গাছ, যার বুকে ফুল ফোটে না কোনোকাল
কোনো ফড়ফড়ানি ফড়িং অথবা চঞ্চল প্রজাপতি যার বুকে কাটায়নি এইটুকু সময় ...
সে কি ভালবাসতে জানে না?
হয়ত জানেডুমুর গাছ শুধু বলে ওঠে,


" ভালোলাগে তাই ভালবাসি "

তার জন্য কোনো রঙিন প্রজাপতির হৃদয় ছুঁতে হয়না
দেখিনি তবু কথা হয় হাওয়ায় হাওয়ায়, সে যখন হাসে হাওয়া কাপে, ফুল ঝরে, বকুলফুল
আজকাল সে ভারি  চুপ থাকে বারোমাস,
তবু নদীর বুক থেকে ভেসে আসে লেবু পাতার গন্ধ,
অমন গন্ধের জন্যই আমাদের অপেক্ষা থাকে চিরকাল