শীতের সেই নীলাভ বিকেলগুলো ক্রমশও ফিকে হয়ে আসছে, আর সেই জায়গা দখল করে
নিচ্ছে একটা হলুদ গোলাপী আলো আলো রঙ যা ছড়িয়ে পড়ছে এই ধুলোময় শহরটার আনাচে
কানাচে । এরকম স্বপ্ন আমি মাঝে মাঝেই দেখি । কিছুক্ষণের জন্য ভেবে নাও
স্বপ্ন দেখাই আমার কাজ । এই তো কিছুদিন আগে পর্যন্ত এ শহরে শীত বুড়ো
জুবুথুবু হয়ে বসে ছিল কিন্তু এখন পাতাঝরার মরশুম শেষ হয়ে এল প্রায় । আসলে
শুন্যস্থান বলে কিছুই হয়না তাই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পলাশ, শিমুল, গুলঞ্চের
শাখায় শাখায় কোত্থেকে আবার নতুন পাতারা আসতে শুরু করেছে - গাছেদের নতুন হয়ে
ওঠার সময় এল, রক্তবর্ণ ফুলগুলো ফুটল বলে। এই পাগলা হাওয়ার শহরটাও রঙ মাখতে
জানে । নিন্দুকেরা বলে এ শহরে নাকি বসন্ত আসে না, কিন্তু আমি যে দেখি সেই
রঙ " ভালবাসার এক ঋতু রঙ " । যখন একঝাক কিশোর কিশোরীরা পাতাঝরার মরশুমকে
পিছনে ফেলে চুইংগম চিবোতে চিবোতে রাস্তা দিয়ে হাটে তখন সেই রঙ এঁকে দেয়
শহরের চালচিত্র, তাদের ভ্রুপল্লভের ডাকে ভেসে আসে চন্দনের গন্ধ । একটা সময়
ছিল যখন বসন্ত আমার মন কেউ রাঙিয়ে যেত, কিন্তু আজকাল মরচে ধরা হৃদয়ে
গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার টিপটিপানি ছাড়া কিছুই অনুভব করি না । আর এই
সবকিছু পাওয়া আর সবকিছু চাওয়ার মাঝে একটা রঙিন ঋতুকাল মাখামাখি হয়ে থাকে
যার জন্য আমাদের অপেক্ষা থাকে চিরকাল ।
অপেক্ষা
করছি অনেকক্ষণ ধরে, ঠিক চিত্পুর থানার সামনে বাসটা জ্যামে আটকেছে । এইসময়
আমার একদম ভালো লাগে না, বিকেল শেষে বাড়ি ফেরার জন্য মনটা ছটফট করে । রোজ
যেন যুদ্ধশেষে রাজপুত্তুরের রাজ্যে ফেরার আকুলতা । অগত্যা বাসের জানলা দিয়ে
বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিলাম । বিকেলের নিভু নিভু সদ্য জন্মানো নিয়নের আলোয়
ভিজে যাচ্ছে শহর । দেশলাই বাক্সের মত দোকানগুলোয় পসরা সাজিয়ে বসছে দোকানদার
। আর সেই সঙ্গে একটা অদ্ভুত শব্দ । ফেরিয়ালা, সাইকেলয়ালা, অটোয়ালা,
রিক্সায়ালা, ট্যাক্সিয়ালা, বাসের কন্ডাক্টরের হাঁক, পথচলতি মানুষের পায়ের
শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে আরো কত চুপ থাকা শব্দরা । এমন সময় একটা অদ্ভুত
জিনিস দেখলাম, দেখি এক ফুচকায়ালা তার চার চাকার সাইকেল ভ্যানটাকে আমাদের
বাসের পাশ দিয়ে ঠেলে নিয়ে চলেছে । আর সেই ফুচকাগাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে হেটে
চলেছে বছর চার পাঁচের একটি ছোট্ট ছেলে হয়ত তার ফুচকায়ালা বাবার হাত ধরে ।
গাড়ির উপর ফুচকা বাক্সের পাশে একটা মাটির টক জলের বড় হাড়ি আর তার পাশে
ছোট্ট একটা ফুটফুটে মেয়ে বসে আছে । নীল ফ্রক পরা । কোলে একটা ওর থেকেও
পুঁচকে সরস্বতী ঠাকুর নিয়ে বসে টুকুস টুকুস করে তাকাচ্ছে চারপাশে । ওর
এইটুকুনু মিষ্টি মুখ আর ওর সেই মিষ্টি পুঁচকে সরস্বতী ঠাকুরটা কে দেখে আমার
ক্লান্ত মনটা বড্ড ভালো বড্ড সবুজ হয়ে উঠলো । দূর থেকে ভেসে আসা ফুলের
গন্ধের মতো মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা । তখন বাবা সরস্বতীর পুজোর আগের দিন
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ভাইঝিকে কোলে নিয়ে আর আমার হাত ধরে ঠাকুর কিনতে যেত ।
আমি অনেক বায়না করলেও বাবা সাদা ও আকাশী রঙের ছোট মাটির ছাঁচের ঠাকুর
কিনতো । কিন্তু আমার মন চাইতো রঙিন কাপড় পরা ঠাকুর কেনার । কিন্তু বাবা
বলত ওগুলো নাকি খুব দামী । তাই আর কেনা হত না । কিন্তু তবুও একটা আসমানী
আনন্দ ছায়ার মতো আমার চারপাশ দিয়ে বয়ে যেত । বাড়ি ফেরার পর মা দুয়োরে
দাড়িয়ে উলু দিত আর বাবা আমাদের ও ঠাকুর সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকত । এরপর দাদা
একটা খবরের কাগজ দিয়ে ঠাকুরের মুখ টা ঢেকে দিত । কিন্তু আমি মাঝে মাঝেই
কাগজ সরিয়ে লুকিয়ে ঠাকুর দেখতাম আর গায়ে হাত বোলাতাম । বড্ড আপনজন মনে হত
আমার ওই শান্ত মাটির মূর্তি টিকে । ওর কাছে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ । হয়ত
কাচা মাটি আর নতুন রঙের গন্ধ মূর্তি টিকে আমার কাছের মানুষ করে তুলত ।
পুজোর দিন খুব সকালে মা কুয়োতলায় গায়ে কাঁচা হলুদ আর তেল মাখিয়ে স্নান
করিয়ে দিত । মা যখন ফল কাটতো পুজোর থালা থেকে নারকলি কুল তুলে খেয়ে নিতাম ।
মা ফুল ফল দিয়ে ঠাকুর সাজাতো । বাবা পুজোয় বসে অঞ্জলির মন্ত্র বলত " জয়
জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে " আর আমি ভুল সব মন্ত্র
বিড়বিড় করে বলে তড়িঘড়ি অঞ্জলি দিয়ে দুপুরে স্কুলে যেতাম লুচি, আলুরদম আর
দরবেশ খেতে । একটু বড় হতেই স্কুলের সরস্বতী পুজোয় ঠাকুর সাজানো, বন্ধুদের
সাথে মিলে সাইকেল নিয়ে হৈহুল্লোর, নানান মেয়েদের স্কুলের রাস্তায় চক্কর
মারা, স্কুল গেটের সামনে এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা - যেন শাড়ি পরা মেয়ে
বস্তুটাই পৃথিবীতে এই প্রথম পা রাখল । এখন বুঝি টিনেজার বয়সটাই ছিল অন্যরকম
। বড্ড রঙিন ছিল সেই দিনগুলো । একটা গোলাপী বিকেল সবসময় জড়িয়ে থাকত আমায় ।
ঠিক সেই বিকেলটাই যেন আজ জড়িয়ে আছে এই নীল ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটির চারপাশে
। স্মৃতির সময় সুখ-দুঃক্ষ কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলে । দেখলাম ফুচকায়ালার
গাড়িকে পিছনে ফেলে আমাদের বাসটা এগিয়ে চলল । আমি পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা
করলাম । শেষ বিকেলের চুইয়ে পড়া আলোয় তারা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে । সেই
সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সেই গোলাপী বিকেল, কুয়োতলা, মায়ের উলু, আসমানী রঙ আর
ফিকে হয়ে আসা বন্ধুত্ব । সেইসব হাজার হাজার বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে তুলতেই
বসন্ত ফিরে আসে।বসন্ত ফিরে আসে বারবার ।
No comments:
Post a Comment