খসে পড়া তারার গায়ে নাকি স্বপ্ন আঁকা থাকে, ছোটবেলায় মা বলত রাতের কোনো খসে পড়া তারার দিকে চেয়ে থাকলে নাকি মনের স্বপ্ন পূরণ হয়, সেদিনের ছোট্ট ছেলেটি সেই রূপকথার গল্প বিশ্বাস করলেও, আজকের সাইন্স পরা ১০ টা ৫ টার অফিস বাবু এ কথা মানতে চায় না | সে সবকিছুকে যুক্তিতক্ক দিয়ে বিচার করতে চায় | তবুও ছোটবেলার সেই মায়ের কথা ছেলেটি আজও ভুলতে পারেনি, তাই আজও সে মনখারাপের রাতে, অন্ধকারে মুখ ঢেকে দাড়ায় কোনো এক ফ্লাট বাড়ির ছাদে, একটি খসে পড়া তারার খোঁজে |
আজ সারারাত চোখে ঘুম নেই, তা না থাকুক, ঘুমিয়ে পড়ার মতো সময় এখনো আসেনি, তাই দু চোখ মেলে দিলাম রাতের আকাশের পানে | একটা অদ্ভুত গন্ধমাখা হাওয়া বইছে, আর সেই হাওয়ায় রাতের অন্ধকারটা ঠিক কালো কম্বলের মতো গায়ে চাপিয়ে নিলাম | লক্ষকোটি বাতি জ্বালিয়েছে আকাশের নক্ষত্রগুলো | ওই তো কালপুরুষ, পিছনে কুকুরটা, হাতে প্রকান্ড ধনুক | এই বীর পুরুষ গড়ার পিছনে কতো তারার অবদান রয়েছে, আমরা শুধু ওই কালপুরুষকেই চিনি, কিন্তু তার শরীর আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে থাকা তারার খবর কেও রাখিনা | কোনো একটি তারা খসে পড়লেই এই কালপুরুষের জীবনেও নেমে আসবে শুন্যস্থান |
ওই তো একটা তারা খসে পড়লো, এবার আর চোখ বন্ধ করে কিছু চাইলাম না, সবসময় চাইবো কেন? কিন্তু সেদিন চেয়েছিলাম জানো? "একটা হলুদ রঙের পাখি"
তখনও শীত পড়েনি, হেমন্তের হাওয়ায় দুপুরের রোদে একটা ঝিম ধরানো গন্ধ, রবিবারের এই সময়টা আমি বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ি | পাশে রাখা একোরিয়ামে দুটো গোল্ড ফিস ছোঁয়াছুঁয়ী খেলছে, হঠাত দেখি বারান্দার রেলিং ঘেসে উপরে ওঠা অপরাজিতার পাতার ফাঁকে এক অচেনা অথিতি, "একটা হলুদ রঙের পাখি" | প্রথমে দেখে বুঝিনি এটা মেয়ে পাখি না ছেলে পাখি? ছোট্ট পাখিটার সারা গা হলুদ পালকে ঢাকা, মাথার নীচে হালকা সবুজ রঙ, বন্ধুত্বের রঙ | হাত বাড়িয়ে দিতেই কাছে এসে বসলো, বুঝলাম ও ওর কিছুটা সময় কাটাতে এসেছে, আপন করে নিলাম ওকে | ধীরে ধীরে বন্ধু হলাম, বন্ধুত্বে মনে হয় পরিধি থাকে না, আমাদেরও ছিলনা | রোজকার খুনসুটিতে আমরা কাটিয়ে দিতাম অনেকটা সময়, গান গাওয়া, গান শেখা সব | কখন যে হেমন্ত বিদায় নিয়ে শীত এসে পড়েছে খেয়ালই করিনি, একটা অদ্ভুত গন্ধমাখা হাওয়া বইছে, সেই হওয়াটা! দাম দিয়ে কেনা রঙ বাহারি ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, বেগনভেলিয়ার বাহারে ভুলতে বসেছিলাম এটা পাতাঝরার সময় |
সেদিন বিকেলেই জানলা দিয়ে শীতের শহরটাকে দেখছি | ঠান্ডায় কেমন জুবুথুবু হয়ে গেছে গতিময় শহরটা, ঠিক সেই সময় আমার পাখি বন্ধু কাধে এসে বসলো | কেমন যেন অচেনা লাগলো ওকে! বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, সেই চঞ্চলতা নেই, তারপর আসতে আসতে বললো নিজের পরিচয় | বললো ও পরিযায়ী | ওর পুরনো বন্ধুরা সব ফিরে এসেছে তাই ওকে ফিরে যেতে হবে পাতাঝরার আগেই | চলে গেল সে | চুপ করে রইলাম অনেকক্ষণ | কথা দিলাম ভুলে যাব, শুধু চেয়ে নিলাম একটা হলুদ পালক | আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো, সন্ধ্যে থেকে রাত | রাতের আকাশে তারাগুলো জোনাকির মতো মিটমিট করছে, হয়ত এখুনি খসে পড়বে কারোর স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে | একটা অদ্ভুত গন্ধমাখা হাওয়া বইছে বিকেল থেকেই, এখনো বইছে |
বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো চোখে পরতেই ইতস্তত ও অসহায় ভাবে চোখের পাতাগুলি একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো | একটা দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে জেগে ওঠার প্রয়াস, যেন নতুন অঙ্কুরোদ্গম | পাতাঝরার দিন শেষ | ঝরে পরা শুখনো পুরনো খয়েরি পাতার স্তুপ ভেদ করে নতুন কচি পাতা মাথা তুলে দিয়েছে নতুন সূর্যের দিকে | এ সূর্যের সাথে কালকের সূর্যের কোনো মিল নেই | সূর্য ও তো একটা নক্ষত্র, তাই কালকের সূর্য্য খসে পরেছে | আজ একটা নতুন দিন, নতুন সূর্য্য, নতুন জীবন | জানলা বন্ধ থাকলেও উদবাস্তুর মতো ফাঁক ফোকর খুঁজে নিয়েছে এই নতুন দিনের আলো | বিছানা ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম | এ কোন সকাল দেখছি? আগে তো দেখিনি! একঝাঁক নতুন আলোয় পাল্টে গেছে চারপাশ | আর সেই পাল্টে যাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধমাখা হাওয়া বইছে, এ অন্য হাওয়া, অন্য গন্ধ | সত্যি বসন্ত এসে গেল! ঠান্ডা হওয়া বিদায় নিয়েছে এই শহর থেকে কোনো পাহাড়ি দেশের উদ্দেশ্যে | পিছনে ফেলে গেছে কিছু ঝরে পরা পাতা, একটা হলুদ পালক আর গতকাল রাতের খসে পরা তারার ইতিহাস |
No comments:
Post a Comment